"এই যে, মোজাম্মেল সাহেব! কেমন আছেন?"
মোজাম্মেল সাহেব একটু ভড়্কে গেলেন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকালেন। এইভাবে আজকাল আর কেউ জিজ্ঞেস করে না "কেমন আছেন?"
আজকাল জিজ্ঞেস করে "কি অবস্থা?"
আগে ব্যাপারটা ছিল ব্যক্তি কেন্দ্রিক, এখন ব্যক্তির সঙ্গে যোগ হয়েছে পারিপার্শিকতা। পারিপার্শিকতার ব্যাপ্তি এখন এতই বিশাল যে কেউ আর চাইলেও নিজের মত করে এখন দিনাতিপাত করতে পারে না। ব্যক্তি এখন গৌণ হয়ে পড়েছে। এদেশের ব্যক্তি-মানুষগুলোর সংখ্যাধিক্যের প্রাচুর্য থাকলেও গুরুত্বের দিক থেকে তারা একেবারেই তলানীতে। এই ব্যাপারগুলো মোজাম্মেল সাহেব আজকাল খুব ভালই বুঝতে পারেন।
ভদ্রলোককে তিনি চিনলেন কিনা বুঝা গেল না। কিন্তু তাকে কেন যেন কাছের মানুষের মত লাগলো বলেই মোজাম্মেল সাহেব জবাব দিলেন...
"খুব ভাল আছি। বেশ বিশ্রাম হচ্ছে। দিনে আড়াই-তিন ঘন্টা গাড়িতে বসেই কেটে যায়। অফিসে যেতে দেড় ঘন্টা, ফিরতে এক ঘন্টা। যে কোন কারনেই হোক, গাড়ির এসি ছাড়তে পারিনা। সূর্য্যতাপ আর চারিদিকে গাড়ির তাপে দিনে দু'বার ঘর্মস্নান হয়ে যায়। অফিসে এক ঘন্টা কাজ করি, আরেক ঘন্টা ছট্ফট্ করি বিদ্যুতের বিরহে। এই বিরহ বেদনা পালা করে দিনে ৪/৫ বার চলতে থাকে।
বাসায় ফিরে শরীরটাকে সটান বিছানায় ফেলে দেই। ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকি নির্নিমেষ। এক সময় চোখ ছলছল করে ওঠে, বুঝতে পারিনা চোখে ধুলো-ময়লা এসে পড়ে কি না ।
রাস্তায় যতটুকু হাঁটি চারিদিক থেকে দানব জেনারেটর আর গাড়ির শব্দে শিশুর মত কেঁদে উঠি ভয়ে, কেবল মনে হয় কারা যেন আসছে!
রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে অপরূপ কিন্তু ভয়ংকর ফলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি...আমি বা আমার সন্তানেরা কোন অপরাধে এদের রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত হলো!
মা-গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবি...কোন্ অপরাধে এই গাছগুলোর সন্তানদের অকালে কেড়ে নিয়ে বিষময় এবং বিষধর করা হলো!
দোকানগুলোতে সারি সারি সাজানো চটক্দার কৌটো-কন্টেইনারগুলো দেখে কেমন ভয় পেয়ে যাই। মনে হয় যেন ওর ভিতরে অবিশ্বাস আর পচে যাওয়া বিবেক লক্লক্ করছে আমাদের খাবে বলে!
এই যে দেখুন না, খানা-খন্দ আর বর্জ্যে ভরা রাস্তাঘাট, পূতিগন্ধময় চারিদিক। নি:শ্বাসে আমরা বিষ নিচ্ছি প্রতিদিন!
জানেন, আজকাল খুব ভয় হয়। কেবলই মনে হয়...কারা যেন আসছে! ভাই, বলতে পারেন অরন্যের ঠিকানা কোথায়? আমি ভাল নেই...আমি ভাল থাকিনা। আমি অরন্যে যাবো...!!!!"
মোজাম্মেল সাহেব হঠাৎ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর কথা বলতে পারেন না...চারদিক থেকে হাজারো কন্ঠে ভেসে আসে..."মোজাম্মেল সাহেব, কেমন আছেন...কেমন আছেন...কেমন আছেন?" তিনি উদ্ভ্রান্তের মত কান চেপে ধরেন। কাঁপতে থাকেন, রক্তিম চোখ দু'টো জানান দেয় তিনি অসুস্থ।
ভদ্রলোক মোজাম্মেল সাহেবকে পাশের ছোট্ট চায়ের দোকানটার বেণ্চিতে বসিয়ে দেন। বাড়ানো পানির গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি, খাবেন কিনা ভাবছেন। তিনি এখন বিশ্বাস করেন যে জাগতিক কোন কিছুতেই আর বিশ্বাস নেই। তিনি পানি খেলেন না। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, "জানেন, দেশের বাড়িতে আমাদের পাশের খেলার মাঠটা মাত্র দু'টি বছরের মধ্যে কংক্রিটের চাপায় হারিয়ে গেল! কংক্রিটের দালান-কোঠায় চারিদিক ভয়াবহ জন্জালে ভরে গেল, পড়ে রইলো শুধু একটা চাপা গলি আর একটা পচা নর্দমা যার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। উপচে পড়া পচা নর্দমার পানিতেই আমাদের কেন হাঁটতে হয় বলতে পারেন? আমাদের পাড়ায় দু'টো বড় পুকুর ছিল, তিনটে মাঠ ছিল, সব ভরে ফেলা হয়েছে। দালান উঠেছে, দোকান উঠেছে, পাশাপাশি নর্দমায়ও ভরে গেছে। কোথাও আর খালি জায়গা পড়ে নেই। কোন শৈশব নেই, কৈশর নেই যে হুটোপুটি হবে। আলো নেই, বাতাস নেই..." এটুকুন বলে মোজাম্মেল সাহেব থামেন, শ্বাস নেন। উদাস তাকিয়ে থাকেন আকাশটার দিকে। বিড়বিড় করে বলেন, এর চেয়ে অরন্য ভাল।
তিনি পথে নেমে পড়েন কিছু না বলেই।
পুনশ্চ: ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে মোজাম্মেল সাহেবের দেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় দেড় বছর আগে। মোজাম্মেল সাহেব আজকাল গাড়ি-বাড়িতে আগুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, গাছ-গাছালী কর্তনের ভয়াবহ উৎসব, এইসব দেখে কি বলবেন? না, কিছুই বলবেন না। তিনি অরন্যে যেয়ে মুক্তি চেয়েছিলেন, যেতে পারেন নি। মাত্র কিছুদিন আগেই তিনি চলে গেছেন অন্য লোকে। তাকে এইসব দিনগুলোর বিভৎসতা দেখে যেতে হয় নি।
২৩ অক্টোবর - ২০১৩
গল্প/কবিতা:
১৬ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪